উদ্দেশ্য
বর্তমানে আন্তর্জাতির বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রায় সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ই বাকীতে বা ধারে হয়ে থাকে। বাকীতে পণ্য বিক্রয় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যেখানে ক্রেতা বিক্রেতা একই দেশের অধিবাসী নন এবং তাঁদের মধ্যে সরাসরি যোগযোগও অনেক সময় থাকে না। বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হলে এবং নতুন ও ঝুঁকিপূর্ণ বাজারে প্রবেশ করতে হলে রপ্তানীকারকে অস্বাভাবিক ঝুঁকি নিয়েই বাকীতে পণ্য বিক্রয় করতে হয়। কিন্তু সব রপ্তানীকারকের পক্ষে এই সব ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়, যদি না এসব ঝুঁকি থেকে উদ্ভৃত ক্ষয়ক্ষতি পূরনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। তাই বৈদেশিক বাণিজ্যে ক্ষেত্রে বাকীতে বিক্রিত পণ্যের মূল্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা জনিত ক্ষতির ঝুঁকির জন্য রয়েছে এক্সপোর্ট পেমেন্ট রিস্ক পলিসি।
বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উভয় ধরনের ঝুঁকির জন্যই এ পলিসি রপ্তানীকারককে ক্ষতি পূরণের ব্যাপক নিশ্চয়তা প্রদান করে। এটি সরাসরি রপ্তানীকারী প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যু করা হয়, তবে এ পলিসির স্বত্ব ব্যাংকের নিকট হস্তান্তর করে ব্যাংক থেকে সহজেই ঋণ নেয়া যায়।
আবরিত ঝুঁকি
নিম্নলিখিত ঝুঁকি সমূহ এ পলিসির আওতায় কভার করা হয়ঃ-
বাণিজ্যিক ঝুঁকি
রাজনৈতিক ঝুঁকি
ঋণ ব্যবস্থাপনা
এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি বিভাগ আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি সম্পন্ন ক্রেডিট রিপোটিং এজেন্সীর মাধ্যমে বিদেশী ক্রেতাদের ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে সক্ষম, যা রপ্তানীকারককে বাকীতে পণ্য বিক্রয়ের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
পলিসির আওতা
বিদেশী ক্রেতার সঙ্গে পাকাপাকিভাবে সম্পাদিত বিক্রয় চুক্তি (ঈড়হভরৎসবফ ঝধষব ঈড়হঃৎধপঃ) অথবা অপরিবর্তনীয় রপ্তানী ঋণ পত্রের (ওৎৎবাড়পধনষব খ/ঈ) মাধ্যমে রপ্তানীকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধজনিত ঝুঁকি এই পলিসির আওতায় কভার করা হয়।
পলিসি গ্রহণের প্রক্রিয়া
রপ্তানীকারক পলিসি লাভের জন্য একটি নির্দিষ্ট ছকে (ইসিজি বিভাগ কর্তৃক সরবরাহকৃত ফরম যথাযথভাবে পূরণ পূর্বক স্বাক্ষর, সীলমোহর ও তারিখ সহকারে) এ বিভাগে প্রস্তাব দাখিল করবেন। প্রস্তাবপত্রে প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রিমিয়ামের হার, সর্বাধিক দায়, সর্বনিম্ন (মিনিমাম) ডিপোজিট প্রিমিয়াম এবং পলিসি ফি উল্লেখ করে কোটেশন জারী করা হবে। কোটেশন যদি রপ্তানীকারকের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় তবে একটি নির্দিষ্ট ফরমে তাঁর সম্মতি সহ উল্লেখিত সর্বনিম্ন (মিনিমাম) ডিপোজিট প্রিমিয়াম এবং পলিসি ফি জমা দেবেন। তারপর রপ্তানীকারকের নামে পলিসি ইস্যু করা হবে।
ক্রেডিট লিমিট অনুমোদন
অপরিবর্তনীয় ঋণপত্র ব্যতিরেকে চুক্তির আওতায় রপ্তানীর ক্ষেত্রে প্রতিটি ক্রেতার বিপরীতে ১১,০০০/= টাকা ফি সহ ক্রেডিট লিমিট অনুমোদনের জন্য নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন পেশ করতে হবে। আবেদন পত্র পাওয়ার সাথে সাথে ইসিজি বিভাগ উক্ত ক্রেতার আর্থিক সততা এবং ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ক্রেডিট রিপোটিং এজেন্সী থেকে ক্রেডিট রিপোর্ট সংগ্রহের উদ্যোগে গ্রহন করবে। তবে এ রিপোর্ট সংগ্রহ করে ক্রেডিট লিমিট অনুমোদন দিতে তিন হতে চার সপ্তাহ সময়ের প্রয়োজন হয়। ক্রেডিট লিমিট অনুমোদনের পূর্বে চুক্তির বিপরীতে রপ্তানীকৃত পণ্যের পেমেন্ট রিস্ক এই পলিসির আওতায় কভার করা হয় না। অতএব, যথাসময়ে ক্রেডিট লিমিট অনুমোদনের জন্য দরখাস্ত পেশ করা বাঞ্চনীয়।
প্রিমিয়াম হার
রপ্তানী বৃদ্ধিতে সহযোগিতার লক্ষ্যে এ পলিসির প্রিমিয়ামের হার খুবই কম রাখা হয়েছে। প্রিমিয়ামের হার রপ্তানীর টার্মস অব পেমেন্ট, ক্রেতার ওপর সংগ্রহীত ক্রেডিট রিপোর্ট এবং ক্রেতার দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর নির্ভরশীল। এলসি’র ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামের হার সর্বনিম্ন ০.১২৫ এবং সর্বোচ্চ ০.৬৫%, চুক্তির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ০.৪০% এবং সর্বোচ্চ ২.০০%। তবে এই হার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরিবর্তনশীল।
মাসিক ঘোষনা
রপ্তানীকারক নির্দিষ্ট ছকে (ইসিজি বিভাগ কর্তৃক সরবরাহকৃত ফর্মে) প্রতি মাসের ঘোষনা স্বাক্ষর ও সীল-মোহর করতঃ পরবর্তী মাসের ১০ তারিখের মধ্যে ইসিজি বিভাগে জমা দেবেন। উক্ত ঘোষনায় সংশ্লিষ্ট মাসে রপ্তানীকৃত পণ্যের বিবরণ এবং কোটেশনে উল্লেখিত হারে প্রিমিয়াম হিসাব করে দেখাতে হবে। মিনিমাম ডিপোজিট প্রিমিয়াম নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর মাসিক ঘোষনার সঙ্গে দেয় প্রিমিয়ামও জমা দিতে হবে। উল্লেখ্য পলিসি মেয়াদে বীমা গ্রহীতা কর্তৃক রপ্তানীকৃত সকল পণ্যের বিবরণ মাসিক ঘোষণাপত্রে যথাসময়ে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। কোন মাসে রপ্তানী না হলে উক্ত মাসে শূণ্য ঘোষণাপত্র দাখিল করতে হবে।
দাবীর প্রাথমিক নোটিশ
পলিসির আওতায় দাবীর আশংকা দেখা দিলে অথবা বিদেশী ক্রেতা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রপ্তানী বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে রপ্তানীকারক কর্তৃক ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই ইসিজি বিভাগে দাবীর প্রাথমিক নোটিশ দিতে হবে এবং সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাসের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ক্ষতিপূরণের হার
এ পলিসির আওতায় রপ্তানীকারককে ওপরে বর্ণিত বাণিজ্যিক ঝুঁকির জন্য ক্ষতির শতকরা ৮৫ ভাগ এবং রাজনৈতিক ঝুঁকির জন্য ক্ষতির শতকরা ৯৫ ভাগ হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, এ ক্ষেত্রে মোট ক্ষতি এ বিভাগ হতে অনুমোদিত সর্বাধিক দায় (maximum liability) এবং প্রতিটি ক্রেতার ওপর অনুমোদিত ঋণ সীমা (approved credit limit) দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকবে।
পণ্যের পরিমানগত বা গুনগত বিরোধ বা রপ্তানীকারক কর্তৃক চুক্তির কোন শর্ত ভঙ্গজনিত কারণে উদ্ভুত ক্ষতি এ পলিসির আওতায় পড়বে না।
দাবী নিষ্পত্তির সময়সীমা
দাবী নিষ্পত্তির সময়সীমা ক্ষতির কারণের উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরুপ, বিদেশী ক্রেতা যদি দেউলিয়া হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে তার দেউলিয়াত্ব প্রমানের সংগে সংগেই রপ্তানীকারককে ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া হয়। ক্রেতা পণ্যের মূল্য পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের ৪ মাস পরে এবং অন্যান্য সব ক্ষেত্রে ঘটনার ৪ মাস পরে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
দাবী সম্পর্কিত কমিটি
অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত একটি কমিটি ইসিজির দাবী নিষ্পত্তি করে থাকে। ইসিজি বিভাগ শুধুমাত্র দাবী সম্পর্কিত কাগজপত্র প্রসেস করে। উক্ত কমিটিতে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই, রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রয়েছেন।
পরিশোধকৃত দাবীর বিপরীতে অর্থ আদায়
ক্ষতি সংগঠিত হওয়ার পর রপ্তানীকারককে ক্রেতার নিকট হতে রপ্তানীকৃত পণ্যের মূল্য আদায়ের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রয়োজনবোধে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। এ ব্যাপারে শৈথিলা দেখা গেলে দাবী নাকচ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের মূল্য বাবদ আদায়কৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট খরচ বাদে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের টাকার অনুপাতে (৮৫:১৫/৯৫:৫) এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি বিভাগ এবং রপ্তানীকারকের মধ্যে ভাগাভাগি করা হবে।
রপ্তানীকারকের করণীয় বিষয়
এক্সপোর্ট পেমেন্ট রিস্ক পলিসি চালু রাখার স্বার্থে রপ্তানীকারকের নিম্নলিখিত কর্তব্য সমূহ পালন করা আবশ্যকঃ
ক) রপ্তানীর তারিখ অনুযায়ী প্রতিমাসের রপ্তানীর বিবরণ সম্বলিত একটি ঘোষণাপত্র (নির্দিষ্ট ছকে) প্রিমিয়াম সহ পরবর্তী মাসের ১০ তারিখে অথবা তার পূর্বে অবশ্যই এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি বিভাগে জমা দিতে হবে। কোন মাসে রপ্তানী না হলে উক্ত মাসে শূণ্য ঘোষণাপত্র দাখিল করতে হবে।
খ) পণ্য রপ্তানীর ক্ষেত্রে রপ্তানীকারক তার স্বাভাবিক সতর্কতা অবশ্যই পালন করবেন এবং রপ্তানী চুক্তির শর্তসমূহ মেনে চলবেন।
গ) এক্সপোর্ট ক্রডিট গ্যারান্টি বিভাগের অনুমোদন ছাড়া রপ্তানী চুক্তির/ঋণ পত্রের কোন শর্ত পরিবর্তন, পরিবর্ধন কিংবা শিথিল করা চলবে না।
ঘ) যদি রপ্তানী মূল্য যথাসময়ে পাওয়ার ব্যাপারে রপ্তানীকারকের সন্দেহ হয় অথবা তাঁর নিকট কোন অস্বাভাবিক অবস্থা পরিলক্ষিত হয় (যেটা পূর্বে ঘটে) তবে তা ঘটার ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই ইসিজি বিভাগে জানাতে হবে এবং ক্ষতির পরিমান হ্রাসের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি বিভাগ রপ্তানীকারকদের জন্য নিশ্চিতভাবে পণ্য রপ্তানীর এক অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করছে। এ নিশ্চয়তার আওতায় থেকে পণ্য রপ্তানীর সুযোগ আপনিও গ্রহণ করুন।